বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:২৯ পূর্বাহ্ন
ভয়েস অব বরিশাল ডেস্ক॥ বাংলার মানুষের মুক্তি, অধিকার আদায়ে, দেশের উন্নয়ন ও লড়াই সংগ্রাম জন্য গঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরান ঢাকার কেএন দাস লেনের রোজ গার্ডেনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’। দলটির জন্মলাভের মধ্য দিয়েই রোপিত হয়েছিল বাঙালির হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের বীজ।
প্রতিষ্ঠার প্রায় চার বছর পর ১৯৫৫ সালে ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করে। ফলে ‘আওয়ামী লীগ’ নামে বাঙালির লড়াই-সংগ্রামের অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
১৯৬৬ সালে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে দলের সভাপতি নির্বাচিত করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার নেতৃত্বেই দলটি বাঙালির অধিকার আদায়ের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের শাসন-নির্যাতন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন, ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন, শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে অধিকার আদায়ের আন্দোলনই এক পর্যায়ে রূপ নেয় স্বাধীনতার সংগ্রামে।
৫২ ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পথ ধরে ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রসর হয় দলটি। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান, ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭৫ সন পর্যন্ত স্বাধীন দেশকে নেতৃত্ব প্রদান, এমনকি পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী দীর্ঘ সময় সংগ্রাম চালিয়ে গেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী এই দল।
এই সুদীর্ঘ পথ পরিক্রমায় আওয়ামী লীগকে অনেক প্রতিকূল পরিস্থিতি ও ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কখনো নেতৃত্বের শূন্যতা, কখনো ভাঙনের মুখে পড়তে হয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর নেতৃত্ব শূন্যতায় পড়ে আওয়ামী লীগ।
বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ-স্বাধীনতা- ইতিহাসে এই তিনটি শব্দ একই সূত্রে গাঁথা। তাই দলের চরম ক্রান্তিকালে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। তার নেতৃত্বে দ্বিধা-বিভক্ত আওয়ামী লীগ আবার ঐক্যবদ্ধ হয়। তিন দশকের বেশি সময় ধরে তার নেতৃত্বে দলটি এগিয়ে যাচ্ছে।
দীর্ঘ রাজনৈতিক পথ পরিক্রমায় অনেক ঘাত-প্রতিঘাত, চড়াই-উতরাই ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে নানান বাঁক পেরিয়ে ৭১ বছরে পড়েছে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া আওয়ামী লীগ। এ দেশের গণমানুষের-ভাবনার ধারক-বাহকে পরিণত হয়েছে দলটি। অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক ভাবধারার আস্থার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। জন্মের পর থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ঐতিহ্যবাহী দলটি বেঁচে আছে দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হিসেবে।
১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দীর্ঘ ২১ বছর বিরোধী দলে অবস্থান করে আওয়ামী লীগ। এরপর ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ফের সরকার গঠন করে। এর আগে এই দলের আন্দোলন সংগ্রামেই প্রতিষ্ঠিত হয় সংসদীয় গণতন্ত্র। সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা নদীর পানি চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তি, যমুনা নদীর উপর বঙ্গবন্ধু সেতু নির্মাণ এবং খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ং-সম্পূর্ণতা অর্জন।
এছাড়া, কৃষকদের জন্য বিভিন্ন কল্যাণমূলক কর্মসূচি এবং ভূমিহীন, দুস্থ মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি চালু করা হয়। বিচার আইন সঠিক ধারায় ফিরিয়ে এনে বিচার ব্যবস্থা পূর্ণগঠন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রম শুরু করা হয়। রাজনৈতিক হত্যা, বঙ্গবন্ধু ও তার সপরিবার, কারাগারে জাতীয় চার নেতা হত্যাসহ সব হত্যার বিচার কার্যক্রম শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা।
এরপর ২০০১ সালের পহেলা অক্টোবর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিরোধী দলে অবস্থানকালে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন ও নেতৃত্বশূন্য করতে বেশ কয়েকবার মারণাঘাত চালায় ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামায়াত জোট। ২১ আগস্ট ভয়াল গ্রেনেড হামলায় শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে প্রাণে বেঁচে গেলেও ঝড়ে যায় অসংখ্য আওয়ামী লীগের নিবেদিত তাজা প্রাণ।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ও মহাজোট ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি গঠিত হয় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
এ সময় মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িতদের বিচার, বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ১৩ হাজার ২৬০ মেগাওয়াটে উন্নীতকরণ, গড়ে ৬ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন, ৫ কোটি মানুষকে মধ্যবিত্তে উন্নীতকরণ, ভারত ও মায়ানমারের সঙ্গে সামুদ্রিক জলসীমা বিরোধের নিষ্পত্তি, প্রতিটি ইউনিয়নে ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, এর মধ্যে দুস্থ মহিলা ও বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, বয়স্কদের জন্য শান্তি নিবাস, আশ্রয়হীনদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প এবং একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্প হাতে মানুষের ভাগ্যের চাকা সচল করতে থাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
এছাড়া, মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, কৃষকদের জন্য কৃষিকার্ড এবং ১০ টাকায় ব্যাংক হিসাব খোলা, বিনা জামানতে বর্গাচাষীদের ঋণ প্রদান, চিকিৎসাসেবার জন্য সারাদেশে প্রায় সাড়ে ১৬ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিক এবং ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন ও বেকারত্ব ঘুচিয়ে দারিদ্র্যের হার অনেক নীচে নামিয়ে আনা হয়।
পরে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি বিএনপি-জামায়াত জোটের শত প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং তৃতীয় বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
এ সময় আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতকরণ, ভারতের পার্লামেন্ট কর্তৃক স্থল সীমানা চুক্তির অনুমোদন এবং দুই দেশ কর্তৃক অনুসমর্থন (এর ফলে দুই দেশের মধ্যে ৬৮ বছরের সীমানা বিরোধের অবসান হয়েছে), মাথাপিছু আয় এক হাজার ৬০২ মার্কিন ডলারে উন্নীতকরণ, দারিদ্র্যের হার ২২ দশমিক ৪ শতাংশ হ্রাস, ৩২ বিলিয়ন ডলারের উপর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন কাজ করে।
এর ধারাবাহিকতায় দেশের জনগণ আবারও আওয়ামী লীগকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বিপুল ভোটে বিজয়ী করে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জনের পর ৭ জানুয়ারি ২০১৯ শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন।
নির্বাচনি অঙ্গীকার অনুযায়ী, ২০২১ সালের মধ্যে ক্ষুধা, দারিদ্র্যমুক্ত, আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি নির্ভর সুখী, সমৃদ্ধ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়াসহ বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করছে দলটি।
এ সময়ে স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুত্তি, বিদ্যুৎ খাত, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীসহ বিভিন্ন খাতের উন্নয়ন দেশের ভেতর-বাইরে প্রশংসিত হয়েছে সরকার। এছাড়া শিক্ষাখাতে অভাবনীয় উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিনামূল্যে বই বিতরণ, মেধাবৃত্তি ও উপবৃত্তি প্রদান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শিক্ষাখাতে বাজেট বরাদ্দ যা জোট সরকারের আমলের ১৩ গুণ বেশি, শিক্ষক নিয়োগ ও মর্যাদা বৃদ্ধি, নতুন বিদ্যালয় স্থাপন, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা, দারিদ্রপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচি, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড, কম্পিউটার ল্যাব ও মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন এবং সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কাজ করছে।
বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ এখন শুধু উন্নয়নের রোল মডেলই নয়, একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবেও প্রশংসিত। বাংলাদেশ আজ ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দেয়ার পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র-চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে।
এছাড়া নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করেছে। দেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু-১’ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। মেট্রোরেল, এলিভেটেট এক্সপ্রেসহ আরো বড় অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। দেশের আইটি খাতের নতুন সম্ভাবনা যশোরে ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক’ করা হয়েছে।
এরইমধ্যে করোনাভাইরাস মোকাবিলার জন্য বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে সরকার। ২০২১ সালের মধ্যে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে প্রাণপণে কাজ করে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার।
স্বাধীনতার স্বপক্ষে শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হাজারো লড়াই, সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষা অতিক্রম আজ ৭১ বছরে পা দিয়েছে। পরিশেষে এইটুকু বলা যায়, আওয়ামী লীগ ও গণতন্ত্রের মানস কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে।
Leave a Reply